ঘটনাটি একটি ইংরেজি গল্পের অনুবাদের সংক্ষিপ্ত রূপ।
শীতপ্রধান দেশের একটি গল্প। একজন ইমাম ও তার ১০ বছরের ছেলেকে নিয়ে প্রতি জুম্মার পরে দাওয়াতি কাজে বেরিয়ে পড়তেন। আমাদের দেশের মতো সেখানে দাঁড়িয়ে বা কাউকে নিয়ে বসে ১০/২০ মিনিট বক্তব্য দেওয়ার সময় নেই। যে যার মতো ব্যস্ত থাকে দুনিয়ার তাড়নায়। তাই তারা দাওয়াতি লিফলেট বা ছোট কাগজের বই বানিয়ে সেটি হাতে হাতে ধরিয়ে দিতেন যেন বাসায় গিয়ে পড়তে পারে।
শীতকালে সেখানে তুষার পড়ে। এক জুম্মায় প্রচুর তুষারপাত হচ্ছিল। ইমাম সাহেব আজকে আর বাইরে যাবেন না ঠিক করলেন। কিছু সময় পরে দেখতে পেলেন তার ছেলে প্রস্তুতি নিয়ে চলে এসেছে। ইমাম সাহেব ছেলেকে বোঝালেন আজকে এই তুষারপাতে তারা বের হবেন না। অবুঝ ছেলেটা খুবই সহজ সরল উত্তর দিলো, “আব্বু, তাহলে আজকে কি কাউকে জান্নাতে যেতে বলবো না? আব্বু, তুষার পড়লে কি জাহান্নাম বন্ধ হয়ে যায়?”
এই উত্তরের জন্য ইমাম সাহেব প্রস্তুত ছিলেন না। তার কাছে কোনো জবাবও ছিল না। অবশেষে ছেলে কিছু বইপত্র নিয়ে একলাই বাইরে যাওয়ার অনুমতি চাইল এবং সময় বেঁধে দিলেন দ্রুত চলে আসার জন্য।
তুষারপাতের মধ্যে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে সে দাওয়াতের বই এবং লিফলেটগুলো বিলাতে লাগলো মানুষের কাছে। যাকেই পাচ্ছে, তার হাতে একটি করে কপি ধরিয়ে দিচ্ছে। বরফ, শীত আর ঠান্ডা হাওয়ায় ছেলেটার শরীর যেন জমে আসছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসার মতো অবস্থা। এই মুহূর্তে তার হাতে আর মাত্র একটি বই। কিন্তু দেওয়ার মতো কাউকেই সে রাস্তায় খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে ভাবলো কোনো একটি বাসায় দিয়ে নিজের বাসায় চলে যাবে। সে সোজাসুজি একটা বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। শীতে তখন সে থরথর করে কাঁপছে। সে বাসাটার কলিংবেল ঘন ঘন বাজাতে থাকলো এবং দরজায় টোকা দিতে লাগলো বেশ কিছু সময় ধরে।
একটু পরে, ভেতর থেকে আস্তে করে একজন মহিলা দরজাটা খুললো। মহিলাকে দেখেই ছেলেটা ফিক করে হেসে দিলো। যেন শীতে শরীর জমে যাওয়ার সমস্ত কষ্ট সে মুহূর্তেই ভুলে গেছে। মহিলার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা হাসিমুখে বললো, “আন্টি, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য খুবই দুঃখিত আমি। আসলে, আমি আপনাকে যে কথাটা জানাতে এসেছি সেটি হলো, আর কেউ আপনাকে ভালোবাসুক বা না বাসুক, পৃথিবীর আর কেউ আপনার খোঁজ করুক বা না করুক, আমাদের রব, মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তালা আপনাকে ভালোবাসেন। আপনার খোঁজ রাখেন এবং আপনার প্রতি তিনি অবশ্যই রহমশীল। এই যে দেখুন, আমার হাতে থাকা এটিই শেষ বই। এই বইটি পড়লে আপনি আপনার রব সম্পর্কে জানতে পারবেন। নিন, এই যে ধরুন…!”
মহিলা মুখ ফুটে কিছুই বললেন না। ছেলেটা মহিলার হাতে বইটি দিয়েই দৌড় দিলো নিজের বাসার দিকে।
পরের জুমা’বার। ইমাম সাহেব নামাজের পর দাওয়াতি বক্তব্য দিলেন। এরপর প্রতিবারের ন্যায় জিজ্ঞেস করলেন, “কারো কি কোনো ব্যাপারে কোনো জিজ্ঞাসা আছে?”
মহিলাদের সাইড থেকে কাপড়ে আবৃত একজন মহিলা দাঁড়ালেন। তিনি সালাম দিয়ে বললেন, “এখানে যারা যারা আছেন, তাদের কেউই আমাকে চেনেন না। চেনার কথাও না। গত জুমা’বার অবধিও আমি ছিলাম একজন অমুসলিম। আমার স্বামী বছর দু’য়েক আগে মারা যান। স্বামী মারা যাবার পর আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে ওঠে। আমার আপনজনরাই আমাকে পর করে দেয়। আমাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে। আমার দুনিয়াটা এতই বিষাদময় হয়ে উঠেছিল যে, আমার মনে হচ্ছিল আমি জীবিত থেকেও মৃত। সিদ্ধান্ত নিলাম- আত্মহত্যা করবো।
দরজা বন্ধ করে, ফ্যানের সাথে দড়ি ঝুলিয়ে তখন আমি আত্মহত্যার জন্য সব রকম প্রস্তুতি সেরে ফেলেছি। একটু পরেই আমি বিদায় নেবো এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে, যে পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই, কেউ না।
যেই আমি চেয়ারে উঠে আত্মহত্যার জন্য চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে যাবো, অমনি হঠাৎ আমার বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। সিদ্ধান্ত নিলাম- দরজা খুলবো না। কিন্তু খেয়াল করলাম, আমার কলিংবেলটা অনর্গল বেজেই চলছে, বেজেই চলছে। কোনো থামাথামি নেই। একটু পর দরজা ধাক্কার শব্দ পেলাম। ভাবলাম, কে হতে পারে? সাতপাঁচ ভেবে এসে দরজা খুললাম। দরজা খুলতেই দেখি, একটি ফুটফুটে ফেরেশতার মতো ছোট্ট ছেলে আমার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। আমি বুঝতে পারছিলাম বাইরের হাড় কাঁপানো কনকনে ঠান্ডায় সে খুব কষ্ট পাচ্ছে। তবুও, আমাকে দেখে সে মিষ্টি একটা হাসি দিলো। এরপর বললো, “আন্টি, পৃথিবীর কেউ আপনাকে ভালো না বাসলেও, একজন আছেন যিনি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসেন। আপনার খোঁজ রাখেন।” এরপর আমার হাতে একটি বই ধরিয়ে দিয়ে সে বিদায় নিলো।
সে চলে যাবার পরে আমি বইটি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। আমার টাঙানো দড়ি তখনও ফ্যানের সাথে ঝুলছিল। আমি আগ্রহবশত বইটা উল্টালাম। খুব মনোযোগ দিয়ে বইটির প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ে ফেললাম।
এরপর আমি লাথি দিয়ে আমার আত্মহত্যার জন্য প্রস্তুত করা চেয়ারটাকে ভেঙে ফেললাম। হেঁচকা টানে ফ্যান থেকে দড়িটা ছিঁড়ে নিলাম। সে সবের আমার আর দরকার নেই। কারণ- খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট উপকরণের সন্ধান ততোক্ষণে আমি পেয়ে গেছি। সেদিনই আমি কালেমা পাঠ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি।
মহিলা বলে যেতে লাগলেন, “মুহতারাম! ছোট্ট ছেলেটার দিয়ে যাওয়া বইটার পেছনে আমি এই মসজিদের ঠিকানাটা পেয়েছি। তাই আজ এখানে ছুটে এসেছি আমি। আমি কেবল সেই ছোট্ট ছেলেটাকে একবার কপালে চুমু খেয়ে একটা ধন্যবাদ দিতে চাই, এজন্য যে, একদম ঠিক সময়ে, সব কিছু শেষ হয়ে যাবার ঠিক একটু আগেই সে আমাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে দিলো…”
ঘটনা শুনে উপস্থিত জনতা ‘হু হু’ করে কাঁদতে শুরু করলো। ইমাম সাহেবের সামনের আসনেই ছোট্ট ছেলেটা বসে ছিল। ইমাম সাহেব অঝোর ধারায় কান্না শুরু করলেন এবং সামনে বসে থাকা তাঁর দশ বছরের ছোট্ট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে চুমু খেতে লাগলেন।
এখানে আমাদের শিক্ষা হচ্ছে, পরিবেশ যতই প্রতিকূল হোক না কেন, দ্বীনের দাওয়াত থেকে যেন আমরা কোনোভাবেই গাফেল না হই।