আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহ
বলছি, ডা. আব্দুর রহমান সুমাইত (রহি.) এর কথা। তিনি কুয়েতের একজন ডাক্টর ;মেডিসিন এবং সার্জারি-বিশেষজ্ঞ ছিলেন। পড়াশোনা করেছেন বাগদাদ ইউনিভার্সিটি, থেকে। ৮-১০ জন ছাত্রের মতো তিনিও স্নাতক সমাপ্ত করেন।এর পর পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে।university of Liverpool থেকে Tropical dieseases এর উপর ডিপ্লোমা কোর্স করেন ১৯৭৪ সালে।এরপর স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেন কানাডার Magil University of Montreal বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই ধাপে তিনি internal diseases এবং gastro enterology the digestive system এর উপর বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন।
এগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো,আমার-আপনার মতই খেটে খাওয়া মানুষ ছিলেন ডাক্তার আব্দুর রহমান সুমাইত। বিয়ে করেছিলেন এক নারীকে যার ডাক নাম উম্মে সুহাইব অর্থাৎ সাহেবের মা। ডা.সুহাইব ছিলেন ‘আবূ সুহাইব’,আর স্ত্রী উম্মে সুহাইব।
উম্মে সুহাইব অত্যন্ত পরহেজগার মহিলা ছিলেন। একদিন তিনি তার স্বামীকে বললেন, ‘সুয়েবের বাবা, একটা কথা আমি চাইনা আর ১০ জন লোকের মত স্রেফ খেয়েপরেই আমাদের জীবন কেটে যাক। এর চেয়ে মহৎ কোন উদ্দেশ্যে আমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই আমাদের আরো বড় কিছু করতে হবে’। স্বামী জানতে চাইলেন, ‘প্রিয়তমা, তুমি কি ভাবছো? আমাকে বলো। ‘স্বামীর বিস্ময় ভেঙে দিয়ে স্ত্রী বললেন, “আমি মনে করি, আমাদের উচিত মানুষদেরকে আল্লাহর পথে আহবান করা, দাওয়াহ দেওয়া।আপনি কি মনে করেন?”আবু সাহাইব বললেন, আমিও তাই মনে করি, আমাদের আসলেই উচিত মানুষদের আল্লাহর পথে আহ্বান করা।’স্বামীকে রাজি হতে দেখে স্ত্রী ভীষণ খুশি –‘চমৎকার ! তাহলে চলুন আমরা পূর্ব-এশিয়ায় যাই আর সেখানে আমাদের বাকিটা জীবন উজাড় করে দেই। আমি শিক্ষকতার পাশাপাশি দাওয়াহ দিলাম।আর আপনি ডাক্তারি পেশা চালিয়ে গেলেন, সাথে সাথে দাওয়াহ দেওয়ারও কাজও করলেন। আল্লাহ যদি আমাদের মধ্যে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দেখতে পান তাহলেই আমরা সফল।
আল্লাহ বলেন,
যদি আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালো কিছু দেখেন, তাহলে তোমাদের থেকে যা নেয়া হয়েছে তা থেকে তিনি অনেক বেশি দেবেন।
এ সময় কুয়েতের প্রাক্তন আমির জাবের এর স্ত্রী,ডাক্তার সুমাইতকে ডেকে পাঠান। তিনি ডাক্তার সুমাইতকে বলেন, আমার জমানো কিছু টাকা আছে এগুলো আপনাকে দিতে চাই। এই টাকা নিয়ে আপনি আফ্রিকায় যাবেন। আর আমার নামে একটা মসজিদ করবেন। আমি চাই মসজিদে নির্মাণ কাজ আপনি নিজেই তদারকি করবেন। তিনি সেই অর্থ গ্রহণ করে বিদায় নেন। এরপর মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যে চলে যান আফ্রিকায়।
আফ্রিকা মহাদেশের এক শহরে অবতরণ করেন তিনি। এরপর শুরু করেন মসজিদ নির্মাণ কাজ। কাজের ফাকেঁ আফ্রিকার কিছু গ্রাম হেঁটে হেঁটে দেখতে থাকেন। এ সময় তিনি যা দেখলেন তাতে প্রচন্ড বিস্ময়, হতাশ ও আতঙ্ক অনুভব করলেন। এতকাল বই পুস্তকে যা পড়েছেন সব যেন চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছেন। তিনি এমন মুসলিমদের দেখা পান, যারা জানে না কিভাবে সূরা ফাতিহা পড়তে হয়। এমন মুসলিমও আছে, যারা জানে না ইসলামের আরকান কি কি, জানে না সালাত কিভাবে পড়তে হয়, ; সাওম-হজ্জ-যাকাতের কথা বাদই দিলাম। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো একদমই ভুলে গেছে।তারা।
ডাক্টর আব্দুর রহমান বলেন,’ শুধু তাই নয় দেখলাম মসজিদের ইমামগণ মসজিদের ভিতরে যিনায় লিপ্ত। তারা জানেই না এগুলো হারাম। আর সাথে আছে অমুসলিমরাও। এছাড়া আরো যা কিছু দেখলেন সবাই ছিল খারাপের শীর্ষে। শিরক আর পৌত্তলিকতায় খেয়ে গেছে গোটা সমাজ। দেখলেন, মানুষজন চাঁদ -তারার পূজা করছে। সাজূা দিচ্ছে গাছকে, সেই সাথে একে অপরকেও। স্রষ্টার ধারণা তাদের অন্তর থেকে যেন সমূলে উঠে গেছে। খ্রিস্টান মিশনারিরা এসেছে আফ্রিকায়। তাদের দাওয়াত পেয়ে টাকার লোভে গ্রামের লোকজন ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হতে শুরু করল। তারা আপন ধর্ম ছেড়ে দিচ্ছে কেবল খাদ্য পানির অভাবে, থাকার কোন জায়গা না পেয়ে।তানযানিয়া,মালাবি,দক্ষিণ সুদান, মাদাগাস্কার,নাইগার ইত্যাদি জায়গায় তিনি এসবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে এলেন।
এসব দেখার পর ডাক্তার সুমাইয়া মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়লেন। যেন আত্মযন্ত্রনায় তার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে উম্মতের এই করুন দশা দেখে। দেশে ফিরে আর দেরি করলেন না। উম্মু সুহাইবকে খুলে বললেন কষ্টের কথাগুলো। কাতর-কন্ঠে বললেন আমাদের অবশ্যই এসব নিয়ে কিছু করা উচিত।স্ত্রী বললেন,আমরা কি করতে পারি?
হ্যাঁ, সেদিন থেকেই ডাক্তার সুমাইত আফ্রিকার মানুষগুলোর হেদায়েতের জন্য উৎসর্গ করে চললেন তার জীবন,সময়,শ্রম, অশ্রু,সম্পদ–সবকিছু। সমস্ত-কিছু আল্লাহর জন্য, আল্লাহর পথে দাওয়াতের জন্য ঢেলে দিয়েছেন উম্মতের এই দরদী পিতা। মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে নয়, এসব তিনি একাই করেছেন নিজ পরিবারকে সাথে নিয়ে। এভাবেই আফ্রিকায় শুরু হয় তার জীবনের নতুন একটি অধ্যায়। ডাক্তার আব্দুর রহমান সুমাইত(রহি) অভিজ্ঞতার কিছু অংশ আমি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি :
ডা. মুসা শরীফ হাফিজাহুল্লাহ পরিচালিত একটি ইন্টারভিউতে অংশগ্রহণ করেছিলেন ডা.আব্দুর রহমান। সেই অনুষ্ঠানে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে এমন কিছু কথা বলেন যা আমাদের চিন্তার বাহিরে। তিনি বলেন,কিছু গ্রামে আল্লাহর দাওয়াত পৌঁছে দেওয়াটা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেই গ্রাম এবং আমাদের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এক বিশাল নদী। বদ্ধ নদী হলেও এতে পানি ছিল বেশ।কিন্তু ময়লা,আবর্জনায় এত টইটম্বুর যে, পানি একদম কালো হয়ে গেছে।সব রকমের রোগ-বালাই আর পোকামাকড়ের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। হেঁটে হেঁটে এই নদী পার হওয়া ছাড়া বিকল্প কোন রাস্তাও ছিল না আমাদের সামনে।
তিনি বলেন, ‘আমরা নদীতে নামি। ধীরে ধীরে এর পানি ও আমাদের গোলা পর্যন্ত উঠে আসে।’ উপস্থাপক প্রশ্ন করেন, নদীর ওপারে পৌঁছাতে এভাবে কতক্ষণ হাঁটতে হয়েছিল?’ শাইখ বলেন, “দুই থেকে চার ঘন্টা”।
প্রিয় পাঠক, ভেবে দেখুন। তিনি একজন ডাক্তার!tropical diseases এর উপর তার ডিগ্রী রয়েছে। খুব ভালোকরেই জানেন, বিষাক্ত পানিতে এতক্ষন থাকা কতটা বিপজ্জনক।
ডা. আব্দুর রহমান বলেন,” আফ্রিকার কাঁচাপথ মাড়িয়ে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতে কখনো কখনো ২০০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে আমাদের। আবার এমনও হয়েছে, তিনদিন পেরিয়ে গেছে কিন্তু খাওয়ার মত কিছু পাইনি।মনে পড়ে, একবার আমি হাঁটু গেড়ে বসে ছিলাম দুর্গন্ধ আর আবর্জনায় ভর্তি একটা পুকুরের ধারে। হাত দিয়ে গর্ত করেছিলাম এই আশায়, যদি গলা ভেজানোর মধ্যে একটু পরিষ্কার পানি পাই….
সত্যিই,দাওয়াত দেওয়ার পথ মোটেও মসৃণ নয়।কিন্তু ডা.আব্দুর রহমান সুমাইত (রহি) উম্মাহকে ইসলামের দাওয়াহ দেওয়ার জন্য কতই না কষ্ট করেছেন কেবলি মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। আল্লাহ তো আমাদের উপর দাওয়াহ দেওয়া ফরজ করেছেন।আমরা নিজেকে একবার প্রশ্ন করি তো আসলেই আমরা দ্বীনের জন্য, উম্মাহর জন্য কি করেছি,আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্য কি করেছি,আর করলে কতটুকুই বা করতে পেরেছি?
ইয়া রব্বি,
“আমাদের সকলকে আপনার পথে কবুল করুন,আমিন”।