উম্মতের ফিকির।
একজন ওয়াহশী
ওয়াহশী!! হ্যাঁ,সেই ওয়াহশীর কথা বলছি, যিনি ওহুদের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (স.)এর প্রিয়তম চাচা হযরত হামজা(রা)কে শহীদ করেছিলেন। মর্মান্তিক এই শাহাদাত এর ঘটনা ওয়াহশীর কুখ্যাতিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। অবশ্য পরবর্তী জীবনে ইসলামের সুশীতল ঝান্ডাতলে আশ্রয় নিয়ে শামিল হয়েছিলেন সাহাবায়ে কেরাম এর নূরানী কাফেলায়। কিন্তু কিভাবে ফিরে আসতে পেরেছিলেন ওয়াহশী!! কোন লাভ অথবা লোভের আশায় নবীজি (স) ক্ষমা করে দিলেন আপন চাচার হত্যাকারী ওয়াহশীর মতো দুর্ধর্ষ খুনীকে? পৃথিবীর ইতিহাসে এইরকম আরেকটি ঘটনা এ যাবত ঘটেছে বলে কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না।ইসলামের এই ক্ষমাশীলতার পেছনে রয়েছে গোটা মানব জাতির ইহ -পারলৌকিক মুক্তির চিন্তা,যা অন্য কোথাও নেই।
উহুদের ময়দান।মুসলমানদের অস্তিত্বের লড়াই। মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (স)।যুদ্ধ পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছিলেন। হামজা(রা)কে কিছুক্ষণ পূর্বেও যুদ্ধের ময়দানে দেখেছেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁকে আর দেখছেন না তিনি। একটু আগেও দু’হাতে তরবারি নিয়ে শত্রুর ভীষণ ভিড়ে প্রচন্ড শক্তি নিয়ে লড়তে দেখেছেন। দু’জন সাহাবীকে পাঠালেন তাঁর খোঁজে। সাহাবীদ্বয় এদিক সেদিক খুঁজে অবশেষে পাহাড়ের পাদদেশে একস্থানে গিয়ে দেখলেন যে,হামজা (রা)শহীদ হয়েছেন। তাঁকে শুধু শহীদই করা হয়নি বরং তাঁর বুক চিড়ে ফেলা হয়েছে। পেট ফাড়া, বের করে আনা হয়েছে নাড়িভুড়ি, কলিজা চিড়ে ফেলা হয়েছে এবং কামড়ে চিবিয়ে তা ছিন্ন ভিন্ন করা হয়েছে। চারদিকে কান্নার রোল পড়ে গেল। অসহ্য এক বেদনায় গুমরে গুমরে কাঁদছেন রাসুলুল্লাহ (স)।
সময় অতিবাহিত হয়। মক্কা বিজিত হলো। ওয়াহশী জীবন বাঁচাতে পালিয়ে গেলো তায়েফে।কিন্তু প্রিয় রাসুল (স) ভুলে যাননি তাকে। তার পরকালের চিন্তায় রাসুলের মন কাঁদে। তিনি একজন সাহাবীকে পাঠিয়ে বলে দিলেন, “যাও ওয়াহশীর সঙ্গে দেখা করো। তাকে বলো সে যেন কালিমা পড়ে নেয়। আল্লাহ পাক তাকে মাফ করে দিবেন। সে জান্নাতে যাবে। “ভুলে গেলেন প্রতিশোধ নেয়ার কথা। উম্মতের ফিকির, হেদায়েতের চিন্তায়,তিনি বিভোর হয়ে থাকতেন।
ওয়াহশীকে কালিমার দাওয়াত দেয়া হলে সে বললো,”আমি চুরি করেছি,ব্যভিচার করেছি,মানুষ খুন করেছি। এমনকি হামজা (রা) এর খুনীও আমি।আমি মদ পান করেছি। আমার আর মাফ পাওয়ার কোন রাস্তা নেই।অন্য কথা বলার থাকলে বলো, তুমি ফিরে যাও।
আল্লাহর রাসুল কালেমার দাওয়াত দিয়ে আবার দূত পাঠালেন। শুধু মাত্র একজনের পরকালীন মুক্তির চিন্তায়।ওয়াহশী রাজি হলেন না। সাহাবী ফিরে এলে আল্লাহর রাসুল তাঁকে আবার পাঠালেন। ঐ সময় ছয়শ কিঃমি পথ পাড়ি দেয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। তবুও শুধুমাত্র একজন মানুষের হেদায়েতের লক্ষ্যে এ প্রচেষ্টা।তাও সে নবীজির চাচার হত্যাকারী।রাসুলুল্লাহ (স) তাকে বললেন তুমি ফিরে গিয়ে তাকে বলো আমার প্রতিপালক আল্লাহ অনেক দয়ালু।তিনি আরও বললেন আল্লাহ শিরক ছাড়া সব গুনাহ মাফ করে দিবেন, যাকে ইচ্ছা। ওয়াহশী দূত মারফত পয়গাম পেয়ে বললো, “তিনি যাকে ইচ্ছা বলেছেন। আমাকে মাফ নাও করতে পারেন। কথার মধ্যে জটিলতা আছে। অন্য রাস্তা দেখো। তুমি ফিরে যাও। ”
আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর। উম্মতের প্রতি,বিশ্ব মানবতার প্রতি,এমনকি আপন চাচার খুনীর প্রতিও কী গভীর ভালোবাসা। আল্লাহ পাক ওয়াহশীর অন্তর ঘুরিয়ে দিলেন। স্রস্টার দিকে, সত্য ও সুন্দরের দিকে, নবীর দিকে, আলোর দিকে।দূতের কথামালা ওয়াহশীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চেতনার সাগরে আছড়ে পড়ছে বিবেকে উদয় হওয়া সত্য সুন্দরের চিন্তা।
বহুদিনের চিন্তা, গ্লানি, অপরাধবোধ তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছিলো।রাত দিন এক করে মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন, সত্যের পথ পাবেন তো, আত্মসমর্পণ এর সুযোগ পাবেন তো?? নাকি সাহাবিদের নজরে পড়ে কতল হতে হয়। এই ভয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে ছুটে চললেন। হুলিয়া, মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়েই এসেছেন। যেমন করেই হোক পৌঁছাতে হবে নবীজির সামনে।
অবশেষে পৌঁছে গেলেন ওয়াহশী। মনে হলো পা জোড়া পেরেক দিয়ে কেউ যেন গেঁথে দিয়েছে। বুকের পাটাতনে আছড়ে পড়ে হৃৎস্পন্দন।নতুন কারো আগমনের খবর পৌঁছে গেলো নবীজির কাছে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন ওয়াহশীর দিকে। ওয়াহশী মনের অজান্তেই মুখ ঢেকে নিলেন। চাঁদরের দেয়াল ফুঁড়ে শব্দ উঠলো” লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ “।হু হু করে কেঁদে উঠলেন ওয়াহশী। দমকা হাওয়ায় তাঁর মুখের চাঁদর সরে গেলে নবীজী বিস্ময়ে বলে উঠলেন তুমি ওয়াহশী!! পলকহীন চাহনিতে কি যেন বিরাজ করছে কেউ জানে না।সাহাবীরা চারদিক হতে খাপ খোলা তলোয়ার নিয়ে আসলেন। অপেক্ষা শুধু হুজুরের নির্দেশ এর।
কিন্তু না, নবীজির তরফ থেকে বলা হলো, “সাথীরা সাবধান, ওয়াহশীকে কেউ ছুঁতে পারবেনা। সে কালিমা পড়ে নিয়েছে। উচ্চারণ করেছে পবিত্র কথাগুলো। ” বসে পড়লেন সবাই। নবীজির চোখে পানি,সবার চোখে অশ্রুঝর্ণা,মনে ব্যথার ঢেউ আছড়ে পড়ছে।
একহাজার অবিশ্বাসী হত্যার চেয়ে একজন বিশ্বাসী হওয়া অনেক ভালো। একজন মানুষ ইসলামে বিশ্বাসী হওয়া মানে তার জীবনে পরম আনন্দ, আলোকময় পথের দিশা পাওয়া। ওয়াহশীর এই বার্তাটিও খুশি ও আনন্দের। সব বেদনার খড়কুটো যেন নিমিষেই ভেসে গেলো।