একবার এক বুজুর্গ আলেম তাঁর এক মুরিদকে (শিষ্য) নিয়ে মসজিদে বসেছিলেন। সেই সময় একজন সাধারণ মুসলমান এসে তাঁর সামনে বসে বলতে শুরু করলো, “হুজুর, আমার জীবনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। পরিবারের মধ্যে অশান্তি, ব্যবসায় ক্ষতি, এবং জীবনে শান্তি নেই। আমি কী করতে পারি?”
আলেম হুজুর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন এবং তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “তুমি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখো এবং তাঁর দেওয়া পরীক্ষাগুলোকে মেনে নাও। কিন্তু এর পাশাপাশি, তোমার কাজ হলো তোমার উম্মতের (সমাজের) জন্য ফিকির (চিন্তা) করা।”
লোকটি বিস্মিত হয়ে বললো, “হুজুর, আমি নিজের সমস্যাগুলোর মধ্যেই আটকে আছি, উম্মতের জন্য কীভাবে চিন্তা করবো?”
আলেম হুজুর মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, “যখন তুমি তোমার উম্মতের জন্য চিন্তা করবে, আল্লাহ তোমার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো সহজ করে দেবেন। উম্মতের কল্যাণের জন্য কাজ করো, তাদের জন্য দোয়া করো, এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো।”
এই কথাগুলো শুনে লোকটির মন পরিবর্তন হলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো যে, নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার চিন্তা বাদ দিয়ে উম্মতের জন্য ফিকির করবে এবং তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করবে। কিছুদিনের মধ্যেই, লোকটির জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। তার পরিবারে শান্তি ফিরে এলো, ব্যবসায় উন্নতি হতে লাগলো, এবং সে নিজেও অন্তরে এক নতুন ধরনের শান্তি অনুভব করতে লাগলো।
এই ঘটনা থেকে শিক্ষা হলো যে, যখন আমরা উম্মতের জন্য চিন্তা করি এবং তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করি, আল্লাহ আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোও সমাধান করেন। উম্মতের ফিকির আমাদেরকে আল্লাহর আরও নিকটে নিয়ে যায় এবং আমাদের জীবনে বরকত আনে।
২০২৪ সালের এইসময়, মুসলিম উম্মাহের বিপদ ও ফিতনার পরিমাণ অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এসময় আমাদের মনকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই হাদীস: “একটি সময় আসবে যখন মুসলমানদের জন্য ঈমান ধরে রাখা, জ্বলন্ত কয়লা হাতের মধ্যে রাখার মতো কঠিন হবে” (তিরমিযি ২২৬০)। এ কথা আমাদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে। আমাদের অবস্থা যেন আজকের দিনে খুবই দুর্বল। আমরা ভুলে গেছি আমাদের মহান রব আল্লাহ তায়ালাকে, এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখিয়ে যাওয়া দ্বীনের পথ।
প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার সময় আমরা দেখি: হালাল-হারাম বিষয়ে অজ্ঞতা ও উদাসীনতা, বেপর্দা, ফ্রি মিক্সিং, নাস্তিক্য মতাদর্শের প্রচলন, সমকামিতা ও LGBTQ+ এর মত ভয়ানক ফিতনার সমর্থন, শিক্ষকদের ডারউইনের বিবর্তনবাদের প্রতি উৎসাহ প্রদান, শিরক, কুফর, মুনাফিকি ইত্যাদি নানা ইমান বিধ্বংসী বিষয় যা অন্তরকে কষ্ট দেয়। এমতাবস্থায় আমরা যদি শুধু নিজেদের ঈমান নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তবে আমাদের অবস্থা সেই ব্যক্তির মতো হবে, যিনি নিজের ইবাদাতে মগ্ন, কিন্তু উম্মতকে চরম অবাধ্যতার থেকে আল্লাহর পথে নিয়ে আসার ফিকির করছেন না। এতে আমাদের ওপর আল্লাহর লানত নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই, নিজেকে শুদ্ধ করার সাথে সাথে উম্মতের ফিকির করা, দাওয়াতি কাজ করা, এবং উম্মতের মাঝে ঐক্য স্থাপন করা আমাদের দায়িত্ব। এই ধরনের ফিকিরের একটি ঘটনা ঘটে একবার একটি জামাতে। বাংলাদেশ থেকে একটি জামাত একটি দেশে গিয়েছিল। ভিন্ন ভাষার কারণে তাদের মধ্যে কয়েকজন দাওয়াতের কাজ করতে পারছিলেন না। কিন্তু তারা গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন—কিভাবে এই মানুষগুলোকে আল্লাহর পথে আনতে হবে। তারা প্রতিদিন তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে রবের কাছে কান্নাকাটি করতেন। আল্লাহ তাদের ফিকির কবুল করেছিলেন। যদিও তারা সরাসরি মানুষদের কাছে দাওয়াত দিতে পারছিলেন না, আল্লাহ তাদের মাধ্যমে অনেক মানুষকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনেন।
আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের ফিকিরে সর্বদা মগ্ন ছিলেন। তার জীবনের শেষ মুহূর্তেও তিনি উম্মতের জন্য দুঃশ্চিন্তা করেছেন। তার শেষ কথা ছিল, “ইয়া উম্মাতি, ইয়া উম্মাতি”—“হে আমার উম্মতেরা, নামাজ, নামাজ…!”
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে উম্মতের ফিকিরে ফিকির করবার এবং নিজেদের ও উম্মতের নাজাতের জন্য কাজ করতে তাওফিক দান করুন। আমিন।