গত দুইদিন যাবত পাশের বাড়ীর গানের শব্দে ঘুমানোও যাচ্ছে না। দৈনন্দিন কোন কাজও মন দিয়ে করতে পারছি না৷ গানের শব্দে দীলের মধ্যে এক অস্থিরতা বিরাজ করছে। এতো জোরে ভলিউম যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার কানে শব্দ চলে আসে।
কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল আব্বাজান রহঃ কথা, তিনি এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে প্রতিবেশীকে বাসায় ডেকে এনে পাশে বসিয়ে সুন্দর করে নসীহা দিতেন৷ তাঁরাও আব্বাকে খুব সমীহ করতেন। আব্বার নসীহা শুনে গান বন্ধ করে দিতেন। ভাবলাম আমিও তাই করবো। দাওয়াত দিবো। হিদায়াতের মালিক তো আল্লাহ। তিনি কখন কাকে হিদায়াত করেন জানা নেই।
আমার জানালা বরাবর যেই ফ্লাটটি রয়েছে সেখানে এক ভার্সিটি পড়ুয়া তরুনী থাকে। প্রায়ই তাকে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এখন ভার্সিটি বন্ধ থাকায় সে সবসময় বাসায় থাকে আর জোরে ভলিউম দিয়ে গান শুনে।
খুব কষ্টে আসরের নামাজ আদায় করে উঠলাম। মনে মনে প্ল্যান করলাম “নাহ এভাবে চলতে পারে না!” আমাকে এর কোন বিহিত করতেই হবে। সাত পাঁচ ভেবে বোরকা পড়ে নিচে নেমে গেলাম। তিনতলা বরাবর ফ্লাটটিতে কাঁপা কাঁপা হাতে কলিংবেল চাপ দিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। কলিংবেল বাজাতেই কেউ একজন গান বন্ধ করে দিলো।
কিছুক্ষণ পর অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণীটি কপাট খুলে বেরিয়ে এলো। আমার আপাদমস্তক ঢাকা দেখে সে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সালাম দিয়ে বললাম, আমি হুজুরের বাসা থেকে এসেছি। মেয়েটি বিস্মিত কণ্ঠে সালামের উত্তর নিলো। আমি বললাম, ভিতরে আসতে পারি? সে মোহগ্রস্তের মতো আমাকে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে পাশ কেটে দাঁড়ালো।
মেয়েটি আমাকে ড্রইং রুমে বসিয়ে নিজেও বরাবর একটি সোফায় বসে পড়লো। কুশল বিনিময়ের পর বললাম, জানো তোমার বাসায় হঠাৎ করে কেন এসেছি? মেয়েটির উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললাম, বাসায় একা একা বোরিং লাগছিল। তাই তোমার এখানে চলে এসেছি। কিছুক্ষণ গল্প করবো বলে।
কি! গল্প করবে না?
— হুম অবশ্যই
— তোমাকে প্রায়ই বেলকনিতে দেখি আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তোমার কি মন খারাপ থাকে নাকি বেশির ভাগ সময়?
— না আপু তেমন কিছু নয়। ক’দিন যাবত ভার্সিটিও বন্ধ কোথাও যাওয়া হয় না। বাসায় একা একা তেমন ভালোও লাগে না।
— তোমাদের বাসায় আর কেউ থাকেন না? দেখছিনা কেন কাউকে?
–আছেন আম্মু শুধু, তিনি বেডরুমে আধশুয়ে টিভি দেখছেন। আপনি বসুন আমি চা নিয়ে আসি। খেতে খেতে গল্প ভালো জমবে।
আমি আর দ্বিমত করিনি। কিছু নসিহত করতে হলে ভালো একটি পরিবেশ খুবই প্রয়োজন।
মেয়েটি উঠে গেল। এই সুযোগে আমি মুখের নিকাব খুলে বসে ভাবছি কিভাবে কি বলা যায় তাকে। ভাবতে ভাবতেই সে উপস্থিত।
— আপু কি আমার বেলকনি বরাবর রুমে থাকেন?
— হুম আপু। তোমাকে তো প্রায় দেখি আমি। জানো তখন খুব ইচ্ছে করে তোমার সাথে জমিয়ে আড্ডা দিতে।
মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল, তাই নাকি আপু! আরও আগে আসলেন না কেন! আমারও খুব ভালো লাগছে আপনি আসাতে।
–আপুনি তোমার নামটি তো এখনো জানাই হয়নি।
কি পড়ছো এবার?
— আমি নূরী আপু। এবার অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছি।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে দু’জন কথা বলতে থাকলাম।
অনেক রকমের গল্প হলো। নূরীর ভার্সিটির বন্ধুদের গল্প, ক্লাসের গল্প আরও কতকিছুর কথাই হলো৷ আমিও বললাম, আমার মেয়েদের সম্পর্কে। সাফুর কথা শুনে তো বলল, ওকে কেন নিয়ে আসলেন না। একটু কোলে নিতাম, আদর করতাম।
— আরেকদিন আনবো ইনশাআল্লাহ।
আলহামদুলিল্লাহ নিমিষেই মানুষকে আপন করে নেওয়ার মতো গুণ রাব্বে কারীম আমায় দিয়েছেন।
অল্প সময়েই পরস্পর খুব ভালো বন্ধুত্বে পরিণত হলাম। নূরী বলল, আপুনি আপনি তো খুব চমৎকার একজন মানুষ৷ অনেক ভালো লাগছে আপনার সাথে গল্প করতে। অনেকদিন বাসায় থেকে খারাপ লাগছিলো। আপনি আসাতে খুব ভালো লাগছে। আবার আসবেন তো আমার বাসায়? বললাম, ইনশাআল্লাহ আসবো গো আসবো।
আপু তোমাকে একটা কথা বলি যদি কিছু মনে না করো।
— হুম আপু বলুন, আমি কিছু মনে করবো না।
— জানো তো গান শুনলে গুনাহ হয়৷
— হুম আপু৷ কিন্তু গান না শুনে থাকতে পারিনা। মন খারাপ থাকলে তখন একটু শুনি।
— শুনো আপু। আমাদের সৃষ্টিকর্তা রাব্বুল আলামিনের নিয়ন্ত্রণে তো সব কিছু তাই না। এমনকি আমাদের মনও। এখন আমরা যদি গান শুনে আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত হই তাহলে কি আমাদের মন ভালো হবে? যেখানে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ কিনা আল্লাহ তায়ালার হাতে। গান শুনলে তো দীলে ঝং ধরে৷ মরীচা পড়ে। অন্তর মরে যায়। হয়তো তুমি ক্ষণিকের জন্যে ভালো লাগা অনুভব করো যা কিনা তোমার অন্তরে মানুষের বড় শত্রু শয়তান সৃষ্টি করে দেয়। শয়তান তো চায়-ই মানুষের খারাপ হোক। মানুষ গোমরাহিতে ডুবে থাকুক।
মোলায়েম কণ্ঠে মমতা জড়িয়ে নূরীকে ডেকে বলি, প্রিয় বোন আমার! করোনার মতো ভাইরাসের ত্রাসে যখন আতঙ্কিত আমাদের জনপদ তখন আমরা কিভাবে পারি বলো আল্লাহর নাফরমানিতে লিপ্ত থাকতে৷ বলো না আপুনি? কিভাবে পারি। আর জোরে ভলিউম দেওয়াতে তোমার প্রতিবেশীরও সমস্যা হয়। একে তো গান শুনে নিজে গুনাহগার হচ্ছো আবার জোরে শুনে মানুষের বিরক্তির কারণ হচ্ছো। জোরে শুনার কারণে যত বেশি মানুষ শুনবে তত মানুষের গুনাহের ভার তোমাকে নিতে হবে। কি বোন মানুষকে বিরক্ত করাতে আরও বেশি পাপী হচ্ছো না?
–হুম আপু
–তাহলে বলো যা শুনলে আমাদের অন্তর মরে যাবে তা আমরা কিভাবে শুনি?
বোন এখনো কি সময় হয়নি রবের দিকে ফিরে আসার?
নূরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আচ্ছা আপুনি আপনি আর কখনই আমার বাসা থেকে গানের শব্দ শুনতে পাবেন না।
সেদিনের পর নূরীর ফ্লাট থেকে আর কোনদিন গানের শব্দ শুনতে পাইনি। আলহামদুলিল্লাহ
জানি না নূরী পেরেছিলো কিনা গান শুনা বাদ দিতে। তবে তাকে একটা গুনাহ থেকে তো বাঁচাতে পেরেছি তাই বা কম কিসে আলহামদুলিল্লাহ।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন