উম্মতের ফিকির ১২

“(উম্মতের ফিকিরে হযরত মুহাম্মদ (স:) এর তায়েফ গমন)
মহানবী সা. প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরুর পর তার ওপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে কুরাইশরা। কুরাইশদের নির্যাতনের সময় ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন চাচা আবু তালিব ও নবীজির সহধর্মীনী হজরত খাদিজা রা.।

তারা মহানবী সা.-কে মানসিকভাবে অভয় ও আশ্বাস বাণী দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সবসময়। তাদের ইন্তেকালের পর কুরাইশদের নির্যাতন বেড়ে যায়। এসময় রাসূল সা. মক্কা থেকে ৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত তায়েফ গমন করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন আজাদকৃত গোলাম ও পালকপুত্র জায়িদ ইবনে হারিসা রা.।
আশা করেছিলেন তায়েফের লোকেরা হয়তো ইসলাম গ্রহণ করবেন। তার এমন প্রত্যাশার দুটি কারণ ছিল— তায়েফের অদূরে বনি সাকিফ গোত্রে মহানবী সা. দুধ পান করেন এবং তায়েফ সর্দারদের একজন কোরাইশ গোত্রে বিয়ে করেছিল।

দুধের আত্মীয় ও গোত্রীয় সম্পর্কের কারণে মহানবী সা. তাদের থেকে সদাচার প্রত্যাশা করেছিলেন।

তায়েফে ১০ দিন তিনি গোপনে, প্রকাশ্যে, একাকী ও সামগ্রিকভাবে দাওয়াত দেন। তিনি বাজারে দাঁড়িয়ে কোরআন তিলাওয়াত করেন এবং ইসলাম ও মুসলমানের পক্ষে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করেন।

কিন্তু তায়েফবাসী তাকে হতাশ করে এবং তারা চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার করে মহানবী সা.-এর ওপর।

রাসূল সা. তায়েফের নেত্রীস্থানীয়দের ইসলামের দাওয়াত দিলে তারা তা মানতে অস্বীকার করলো এবং তায়েফের সাধারণ মানুষদের মহানবী সা.-এর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলল। তারা মহানবী সা.-কে তায়েফ ত্যাগের নির্দেশ দিল। মহানবী সা. সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় উচ্ছৃঙ্খল বালকদের তার পেছনে লেলিয়ে দিল। তারা নবীজি সা.-এর দিকে পাথর নিক্ষেপ করে গালাগাল করতে শুরু করল। তাদের পাথরের আঘাত ও অত্যাচারে মহানবী সা.-এর পুরো শরীরের রক্তাক্ত হয়ে যায়। রক্তে তার জুতা ভরে যায়।
এ সময় জায়িদ রা. অসামান্য আত্মত্যাগ স্বীকার করেন। তিনি মহানবী সা.-এর জন্য ঢাল হয়ে যান। যে দিক থেকে পাথর ছোড়া হচ্ছিল তিনি সেদিক থেকে তাঁকে আগলে রাখছিলেন। ফলে তার মাথার কয়েক জায়গায় কেটে যায়। তাদের এই অত্যাচারে রাসূলুলুল্লাহ সা. মাটিতে বসে পড়তেন। তখন হতভাগারা তাঁর হাত ধরে উঠিয়ে দিত এবং সামনে চলতে বলত। আর সামনে পা বাড়ালেই পাথর নিক্ষেপ করত।
তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত মক্কার উতবা, রাবিয়া ও শায়বাদের বাগানে আশ্রয় নেওয়া পর্যন্ত দুর্বৃত্তরা মহানবী সা.-এর পিছু নিয়েছিল। এখানে আশ্রয় নেওয়ার পর তিনি একটি দোয়া করেন। যা ‘দোয়ায়ে মুস্তাদয়িফিন’ (অসহায় মানুষের দোয়া) নামে পরিচিত।
তিনি তার দোয়ায় বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছেই ফরিয়াদ জানাই আমার দুর্বলতার, আমার নিঃস্বতার এবং মানুষের কাছে আমার মূল্যহীনতার। আপনি দয়ালুদের মধ্যে সর্বাধিক দয়ালু। অসহায় ও দুর্বলদের প্রতিপালক তো আপনিই! আমার প্রতিপালকও আপনি। আপনি কার হাতে আমাকে সোপর্দ করেছেন। অনাত্মীয় রুক্ষ চেহারাওয়ালাদের কাছে অথবা এমন শত্রুর কাছে আমাকে ঠেলে দিচ্ছেন, যারা আমার ও আমার কাজের ওপর প্রবল। আপনি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হন তবে এর পরও আমি কোনো কিছুর পরোয়া করি না। তবে আপনার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ও আফিয়াত আমার জন্য অধিক প্রশস্ত। হে আল্লাহ, আমি আপনার সত্তার নূরের আশ্রয় প্রার্থী, যা দিয়ে সমগ্র আঁধার আলোকিত হয়ে যায় এবং দ্বিন ও দুনিয়ার সব কিছু পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আপনি আমার ওপর কি অভিশাপ অবতীর্ণ করবেন বা ক্রোধান্বিত হবেন যে অবস্থায় আমি আপনার সন্তুষ্টি কামনা করি। সব শক্তি ও ক্ষমতা শুধু আপনারই। আপনার শক্তি ছাড়া কোনো শক্তি নেই।’
এ সময় আল্লাহ তায়ালা তায়েফের পাহাড়ের ফেরেশতাদের পাঠান। তারা মহানবী সা.-এর কাছে দুই পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত তায়েফের অধিবাসীদের পাহাড়ে পিষে ফেলার অনুমতি চাইল। কিন্তু মহানবী সা. তা দিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, আমি আশা করি, তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন লোক জন্ম নেবে যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না।
অতঃপর তিনি ‘ওয়াদীয়ে নাখলা’ নামক জায়গায় এসে কয়েক দিন অতিবাহিত করলেন। তিনি রাত্রে সেখানে দাঁড়িয়ে সলাত আদায় করছিলেন। তখন আল্লাহ রাববুল আলামীন জিনদের একটি দল তাঁর নিকট প্রেরণ করেন। তারা নাবী (ﷺ) এর কুরআন তিলাওয়াত শুনল। কুরআনের এই আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে তিনি তাদের আগমণ সম্পর্কে অবগত হতে পারেন নি। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَإِذْ صَرَفْنَا إِلَيْكَ نَفَرًا مِنْ الْجِنِّ يَسْتَمِعُونَ الْقُرْآنَ فَلَمَّا حَضَرُوهُ قَالُوا أَنْصِتُوا فَلَمَّا قُضِيَ وَلَّوْا إِلَى قَوْمِهِمْ مُنْذِرِينَ
স্মরণ কর সেই সময়ের কথা যখন আমি তোমার প্রতি প্রেরণ করেছিলাম একদল জিনকে। যারা কুরআন পাঠ শুনছিল। যখন ওরা তার নিকট উপস্থিত হলো, ওরা একে অপরকে বলতে লাগল- চুপ করে শ্রবণ কর। যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হল ওরা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল, এক একজন সতর্ককারীরূপে’’। (সূরা আহকাফ-৪৬:২৯-৩১)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেন-
قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنْ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا
বলোঃ আমার প্রতি এই মর্মে অহী প্রেরিত হয়েছে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছে, আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি’’।[2]
‘নাখলা’ নামক জায়গায় কয়েকদিন অতিবাহিত করার পর যায়েদ তাঁকে বললেন- মক্কার কুরাইশরা আপনাকে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছে। এখন আপনি কিভাবে সেখানে প্রবেশ করবেন? তিনি বললেন- হে যায়েদ! তুমি যেই মসীবত প্রত্যক্ষ করছ, আল্লাহ্ তা‘আলা তা অবশ্যই বিদূরিত করবেন, তিনি তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন এবং তাঁর নাবীকে সাহায্য করবেন।

মক্কার নিকটবর্তী হয়ে তিনি খোযা’আ গোত্রের একজন লোকের মাধ্যমে মুতইম বিন আদীর কাছে আশ্রয় চাইলেন। তিনি মুতইমকে বললেন- আমি তোমার আশ্রয়ে মক্কায় প্রবেশ করতে চাই। সে রাজী হল এবং ঘোষণা দিল যে, আমি মুহাম্মাদকে আশ্রয় দিচ্ছি। সে তার ছেলেদেরকে ডেকে বলল- তোমরা অস্ত্র হাতে নাও এবং কাবার চারপাশে দাঁড়িয়ে যাও। আমি মুহাম্মাদকে আশ্রয় দিচ্ছি। যায়েদকে সাথে নিয়ে তিনি মুতইম বিন আদীর আশ্রয়ে কাবায় প্রবেশ করলেন। মুতইম বিন আদী স্বীয় বাহনের উপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিল যে, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি মুহাম্মাদকে আশ্রয় দিয়েছি। সুতরাং কেউ যেন তাঁর উপর আক্রমন না করে।

অতঃপর নাবী (ﷺ) হাজরে আসওয়াদের কাছে গিয়ে তাতে চুম্বন করলেন এবং দু’রাকাত সলাত আদায় করলেন। মুতইম বিন আদী এবং তার ছেলেরা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নাবী (ﷺ) কে বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিলেন।[3]

উম্মতের ফিকিরে আমাদের মহানবি (সঃ) এভাবেই সারাজীবন হাজারো কষ্ট নির্যাতন সহ্য করেছেন,সারাজীবনে ওনার একটাই ফিকির ছিলো,ওনার উম্মত কে কিভাবে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে নেয়া যায়।নবীজীর রওজামুবারক এ নবীজি এখনও তার উম্মতের জন্য কাঁদছেন।

এখন নবীজি (সঃ) এর উম্মত হিসেবে আমাদের উচিত, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের দেখানো পথে চলা ,আল্লাহর ইবাদত করে নিজেও জাহান্নাম থেকে বাঁচা, নবীজির পুরা উম্মত কে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে নেয়া,,আমরাও সারাজীবন আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল এর দেখানো পথে নিজেও চলব এবং অন্য কেও চালাবো। ইনশাআল্লাহ 🤲❤️”

অপেক্ষা করুন

0