উম্মতের ফিকির ১০

শোকের বছর।
নবুয়তের ১০ বছরে পঞ্চাশোর্ধ আল্লাহর রাসুল (ﷺ) তার পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা হারিয়ে চিন্তা করছিলেন নিকটস্থ কোন অঞ্চলে দাওয়াতের কাজ শুরু করতে। তৎকালীন সময়ে শহর হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তার দৃষ্টি ছিল তায়েফের দিকে। সঙ্গে তার মুক্তিপ্রাপ্ত দাস যায়েদ ইবনে হারিছা (রা:)-কে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন তায়েফের উদ্দেশ্যে। সতর্কতার জন্য তায়েফ যাত্রার ৭০ মাইল পারি দিলেন পায়ে হেঁটে!
যেকোনো অঞ্চলের নেতা দ্বীনের দাওয়াত কবুল করলে বাকিদের সে দাওয়াত কবুল করা সহজ হয়। তাই নবীজি (ﷺ) সেখানকার তিন নেতার সাথে কথা বলতে গেলেন। এরা ছিলও তিন ভাই, প্রথম-জন রাগান্বিত হয়ে আল্লাহর রাসুল (ﷺ)কে বললেন, “আল্লাহ যদি তোমাকে রাসুল হিসেবে প্রেরণ করে থাকে তাহলে আমি নিজ হাতে কাবার গিলাফকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবো”। দ্বিতীয়জন বলল, “আল্লাহ কী রাসুল হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য তোমার চেয়ে ভালো কাউকে পাননি!”। তৃতীয়-জন বলল, “তুমি যদি সত্যই নবী হয়ে থাকো তাহলে তোমার সাথে আমি কথা বলতে পারবো না কারণ তোমার স্তর আমার অনেক উপরে। আর তুমি যদি মিথ্যা বলে থাকো তাহলেও তোমার সাথে কথা বলতে পারবোনা, কেননা আমার অবস্থান তোমার থেকে অনেক উপরে।”
নেতাদের কাছে সারা না পেয়ে আল্লাহর রাসুল (ﷺ) সাধারণ মানুষদের কাছে দাওয়াত নিয়ে গেলেন। কিন্তু একজন ব্যক্তিও তার সেই দাওয়াত কবুল করলো না। তাদের ফিরে আসার সময় কাফের নেতারা তাদের পেছনে দুর্বৃত্ত লেলিয়ে দিলেন। এসকল লোক নবীজিকে উদ্দেশ্য করে পাথর নিক্ষেপ করতে লাগলো। বিশেষ করে নবীজির পায়ের দিকে, যেন বেশিদূর হেটে যেতে না পারে। শুধুমাত্র শহরের মধ্যে না, শহর থেকে বের হওয়ার পর ৫ মাইল পর্যন্ত এসকল লোক নবীজির উপর পাথর নিক্ষেপ করেছিল। চিন্তা করুন মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হলে এতটুকু রাস্তা কাউকে পাথর মারার জন্য যাবে।
অনেক রাস্তা আসার পর আল্লাহর রাসুল (সা:) আশ্রয় নিলেন একটি গাছের গোঁড়ায়। টেনে টেনে রক্তে জমাট বাধা পা জুতা থেকে বের করা হল। তারপর তিনি দু’আ করেন। ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে স্বীয় দুর্বলতা, (মানুষকে বুঝাতে) আমার কলা-কৌশলের স্বল্পতা এবং মানুষের কাছে আমার মূল্য-হীনতার অভিযোগ করছি। হে সর্বাধিক দয়ালু! তুমি দুর্বলদের প্রভু, আমারও প্রভু। তুমি আমাকে কার কাছে ন্যস্ত করছ? তুমি কি আমাকে দূরের এমন অচেনা কারও হাতে ন্যস্ত করছ, যে আমার সঙ্গে কঠোর ব্যবহার করবে? নাকি কোনও শত্রুর হাতে সোপর্দ করছ, যাকে তুমি আমার বিষয়ের মালিক করে দিয়েছ? তুমি যদি আমার উপর রাগান্বিত না হও তাহলে আমি কোনোকিছুই পরওয়া করি না। তবে নিঃসন্দেহে তোমার ক্ষমা আমার জন্য সর্বাধিক প্রশস্ত ও প্রসারিত। আমি তোমার সেই চেহারার আলোর আশ্রয় চাই, যা দ্বারা অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যায় এবং যা দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বিষয় সংশোধন হয়। এই কথার মাধ্যমে আমার উপর তোমার ক্রোধ নেমে আসা হতে অথবা আমার উপর তোমার অসন্তুষ্টি নাজিল হওয়া থেকে তোমার আশ্রয় চাই। তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই আমার সকল প্রচেষ্টা। তোমার সাহায্য ছাড়া অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় এবং তোমার তাওফিক ও শক্তি ছাড়া তোমার আনুগত্য করা অসম্ভব।’
তার এই কষ্ট দেখে আল্লাহ জিবরীল্ (আ:)কে তার কাছে পাঠিয়ে দেয়। জিবরীল (আঃ) তাকে বলেন, “আল্লাহ দেখেছেন তারা আপনার সাথে কী করেছে!”। আল্লাহ আপনার জন্য পাহাড়ের ফেরেশতা পাঠিয়েছেন। পাহাড়ের ফেরেশতা নবীজিকে বললেন, “আপনি আদেশ করুন, তাদেরকে দুই পাহাড়ের মাঝে পিষে ফেলি।“ আল্লাহর রাসুল (সা:) বললেন, “আমি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি, আমার শুধু একটাই ইচ্ছা, এরা মুসলিম না হলেও এদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন মুসলিম হয়। আল্লাহ তার এই দু’আ কবুল করেছেন, আজ তায়েফ-বাসী মুসলিম। তার এই তায়েফ যাত্রার ফেরার সময় শুধু খাবার আগে বিসমিল্লাহ বলার জন্য এক দাস মুসলিম হয়ে যায়, তাহাজ্জুদে তিলাওয়াত শুনে জ্বীনেরা ইসলামের দ্বায়ী হয়ে যায়।

অপেক্ষা করুন

0